
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান গোলাম আকবর চৌধুরী সরকরদলীয় এক শীর্ষ নেতার স্বামী হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিতে এমন তুঘলকিকাণ্ড চলছে। আর সেকারণে বিষয়টি জেনেও অনিয়ম বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
আইডিআরএ ও সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সংঘ-স্মারক (ঝ) অনুসারে কোম্পানির চেয়ারম্যান গোলাম আকবর চৌধুরী উদ্যোক্তা পরিচালক। আর সংঘ বিধিমালার ১৩০ (ক) অনুসারে তিনি পরিচলনা পর্ষদের প্রধান। অর্থাৎ তিনি লাভজনক পদে রয়েছেন। তাই কোম্পানির মুনাফার অংশ ছাড়া তিনি মাসিক সম্মানী বা বেতন গ্রহণ করতে পারেন না। অথচ তিনি প্রতিনিয়ত কোম্পানি থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করছেন। কোম্পানিটিতে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা।
এছাড়া বিমা আইন ২০১০-এর ৭৮ ধারা অনুযায়ী, কোম্পানিতে চাকরি করে কেউ বিমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারেন না। এ বিষয়ে ৭৮ ধরায় বলা হয়েছে, আপাততঃ বলবৎ অন্য কোনো আইন বা বিমাকারীর সংঘবিধিতে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি বিমাকারীর চাকুরিতে উপদেষ্টা, নিরীক্ষক, পরামর্শক বা অন্য কোনো লাভজনক পদে নিয়োজিত থাকলে তিনি ওই বিমাকারীর পরিচালক হওয়ার বা থাকার যোগ্য হবেন না।
প্রতিষ্ঠানটির ২০১৩ সালের বেতনের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চেয়ারম্যান গোলাম আকবর চৌধুরী এক বছরে পারিশ্রমিক হিসেবে তুলে নিয়েছেন ৪৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এরমধ্যে বেতন হিসেবে ২৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা, বোনাস ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা ও অন্যান্য পারিশ্রমিক বাবদ ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন।
আর হাস্যকর হলেও সত্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের শীর্ষ নির্বাহী হয়েও মো. মনজুরুল হকের মাসিক বেতন মাত্র ১৮ হাজার টাকা। তিনি এক বছরে কোম্পানি থেকে বেতন হিসেবে গ্রহণ করেছেন দুই লাখ ১৬ হাজার টাকা। এছাড়া বোনাস বাবদ ৩৬ হাজার টাকা ও অন্যান্য পারিশ্রমিক বাবদ এক লাখ ৪৪ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এক বছরে তিনি কোম্পানি থেকে সবমিলে পারশ্রমিক নিয়েছেন তিন লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
অথচ তার কয়েক ধাপ নিচের পদে বিপণন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক হিসেবে চেয়ারম্যান পুত্র সাজেদ আকবর বছরে পারিশ্রমিক হিসেবে গ্রহণ করেন ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিনি কোম্পানি থেকে মাসে গ্রহণ করেন ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যা এমডির তুলনায় আট দশমিক ৩৩ ভাগ বেশি।
সাজেদ আকবর ২০১৩ সালে বেতন হিসেবে নিয়েছেন ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া বোনাস বাবদ তিন লাখ ও অন্যান্য খরচ বাবদ ১২ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান গোলাম আকবর চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, এমডির বেতন দেওয়া হয় বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সব কাজ আমি নিজেই করি। এমডি শুধু পর্যবেক্ষণের (মনিটরিং) কাজ করেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি প্রতিষ্ঠানটির এমডির দায়িত্বে থাকা মো. মনজুরুল হক।
প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ সাত কর্মকর্তার ২০১৩ সালের পারিশ্রমিক দেওয়ার তালিকা থেকে দেখা গেছে, চেয়ারম্যান পুত্র ছাড়াও দুইজন উপদেষ্টা ও একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) নিচের পদে চাকরি করেও এমডির চেয়ে বেশি বেতন নিচ্ছেন।
এদের মধ্যে এমডির অধীনস্ত কর্মকর্তা বিপণন বিভাগের উপদেষ্টা এ কে এম মহিউদ্দিন। তিনি এক বছরে কোম্পানি থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছেন ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। এরমধ্যে বেতন ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা, বোনাস এক লাখ ২০ হাজার টাকা, ভ্রমণ ভাতা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা ও অন্যান্য পারিশ্রমিক বাবদ পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। সে হিসাবে তিনি কোম্পানি থেকে মাসে পান এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।
উপদেষ্টা আবু সালেহের বার্ষিক মূল বেতন ৩ লাখ টাকা। বছরে তার বোনাস ৬০ হাজার টাকা, ভ্রমণ ভাতা ২০ হাজার টাকা। অন্যান্য পারিশ্রমিক বাবদ বছরে পান এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। তিনি বছরে প্রতিষ্ঠান থেকে পান পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এমডির অধীনস্ত আর এক কর্মকর্তা অবলিখন বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহম্মদ ইউনুসের বার্ষিক মূল বেতন দুই লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ টাকা। তার বার্ষিক বোনাস ৪৭ হাজার ৪০০ টাকা, ভ্রমণ ভাতা ১৪ হাজার ৪০০ টাকা ও অন্যান্য পারিশ্রমিক এক লাখ ৭৫ হাজার ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে মুহাম্মদ ইউনুস এক বছরে পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছেন পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৪০০ টাকা। যা এডির থেকে এক লাখ ২৫ হাজার ৪০০ টাকা বেশি।
প্রতিষ্ঠানটিতে অর্থ ও হিসাব বিভাগে উপব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন মলয় কুমার সাহা। বছরে তিনি সব মিলিয়ে কোম্পানি থেকে নিয়েছেন দুই লাখ ৮৫ হাজার ৬০০ টাকা। এরমধ্যে বেতন এক লাখ ৫১ হাজার ২০০ টাকা, বোনাস ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা, ভ্রমণ ভাতা ১৮ হাজার ৪৫০ টাকা ও অন্যান্য পারিশ্রমিক ৮২ হাজার ৩৫০ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির পারিশ্রমিকের এমন চিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একধিক প্রতিষ্ঠানের এমডি। তাদের মতে, চেয়ারম্যান কখনো কোম্পানিতে বেতনভুক্ত কর্মকর্তাদের মতো চাকরি করতে পারে না। কিন্তু সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স থেকে চেয়ারম্যান নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তাদের বেতনের চিত্র দেখলে সহজেই বোঝা যায় প্রতিষ্ঠনটিতে চরম স্বেচ্ছাচারিতা বিরাজ করছে।
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ-এর চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে চেয়ারম্যানের বেতন নেওয়া বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে আইডিআরএ-এর একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ২০১১ ও ২০১২ সালের বেতনের তালিকাতেও একই চিত্র দেখতে পায় আইডিআরএ। এ সময় বেতন হিসেবে চেয়ারম্যানের নেওয়া অর্থ কোম্পানিতে ফেরত আনার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করে আইডিআরএ। তবে অদৃশ্যকারণে আইডিআরএ-এর সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি।
0 comments:
Post a Comment